সপ্তাহের শুরুতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জানুয়ারির ভোক্তা মূল্য সূচক (CPI) প্রকাশিত হওয়ার পর বিটকয়েন দ্রুত দরপতনের শিকার হয়েছিল, যার ফলে মূল্য $94,000 পর্যন্ত নেমে যায়। ১২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায় যে প্রধান এবং মূল ভোক্তা মূল্য সূচক পূর্বাভাসের চেয়ে বেশি এসেছে, যা মার্কিন অর্থনীতিতে চলমান মূল্যস্ফীতির চাপ নির্দেশ করে। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয় যে ফেডারেল রিজার্ভ আরও হকিশ বা কঠোর মুদ্রানীতি গ্রহণ করতে পারে, যা উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের ওপর, বিশেষ করে বিটকয়েনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
ঐতিহাসিকভাবে, বিটকয়েনের ট্রেডাররা সামষ্টিক প্রতিবেদনগুলোর প্রতি তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তবে চলমান পরিস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। প্রথমবারের মতো, নতুন ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে মার্কিন ভোক্তা মূল্য সূচক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যা মার্কেটে অনিশ্চয়তার সাথে রাজনৈতিক মাত্রা যোগ করেছে। প্রতিবেদনের প্রকাশের পরপরই বিটকয়েনের মূল্য প্রায় $2,000 হ্রাস পায়, তবে দিনের শেষে সেই দরপতনের বড় একটি অংশ পুনরুদ্ধার করা হয়।
বিনিয়োগকারীরা মার্কেট থেকে চলে যাচ্ছে নাকি প্রবেশের সুযোগ খুঁজছে?
সাম্প্রতিক এই দ্রুত দরপতন মার্কিন বাজারের সামষ্টিক অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ঘটনাগুলোর প্রতি বিটকয়েনের সংবেদনশীলতা আবারও তুলে ধরেছে। মার্কিন ক্রিপ্টো বিনিয়োগকারীদের মনোভাব বোঝার একটি কার্যকর উপায় হলো কয়েনবেস প্রিমিয়াম সূচক। এই সূচকটি আন্তর্জাতিক এক্সচেঞ্জগুলোর তুলনায় কয়েনবেসে বিটকয়েনের মূল্যের কতটা পার্থক্য রয়েছে তা পরিমাপ করে, যা মার্কিন বিনিয়োগকারীদের চাহিদার মাত্রা নির্দেশ করে। এই সূচকের ইতিবাচক মান চাহিদা বৃদ্ধির সংকেত দেয়, যখন নেতিবাচক মান স্থানীয় ট্রেডারদের সক্রিয়ভাবে বিটকয়েন বিক্রির ইঙ্গিত দেয়।
ক্রিপ্টোকোয়ান্টের তথ্য অনুসারে, ১২ ফেব্রুয়ারি ভোক্তা মূল্য সূচক প্রকাশের আগেই কয়েনবেস প্রিমিয়াম সূচক কমতে শুরু করে এবং প্রতিবেদন প্রকাশের পরপরই এটি আরও হ্রাস পায়। যেহেতু কয়েনবেস মার্কিন খুচরা এবং প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের প্রধান প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করে, তাই এই প্রবণতা নির্দেশ করে যে ট্রেডাররা নেতিবাচক সামষ্টিক অর্থনৈতিক সংবাদ আসার আশঙ্কায় ঝুঁকি কমানোর চেষ্টা করছিল।
তবে, মূল প্রশ্ন এখনো রয়ে গেছে: বিনিয়োগকারীরা মার্কেট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, নাকি ক্রয়ের জন্য আরও ভালো সুযোগের অপেক্ষায় আছে?
মূল্যস্ফীতি এবং রাজনীতি: ক্রিপ্টো মার্কেটের জন্য হুমকি নাকি সুযোগ?
মার্কিন বিনিয়োগকারীরা সম্ভবত মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির এবং ফেডারেল রিজার্ভের কঠোর নীতির সম্ভাবনা প্রত্যাশা করেছিল, যা উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের ওপর, বিশেষ করে বিটকয়েনের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। কয়েনবেস প্রিমিয়াম সূচক-এর নেতিবাচক গতিবিধি এই উদ্বেগগুলোকে সমর্থন করে। তবে, ঐতিহাসিকভাবে দেখা গেছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়গুলো প্রায়ই বিটকয়েনের দর৪ বৃদ্ধির অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে, কারণ এই ক্রিপ্টোকারেন্সিকে মুদ্রার অবমূল্যায়নের বিরুদ্ধে সুরক্ষা হিসেবে দেখা হয়।
ক্রিপ্টোকোয়ান্টের জানুয়ারি ১৩ থেকে ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৫ পর্যন্ত কয়েনবেস প্রিমিয়াম সূচক বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে জানুয়ারি জুড়ে সূচকটি মাঝে মাঝে নেতিবাচক অঞ্চলে প্রবেশ করেছিল। এই সূচক এবং বিটকয়েনের মূল্যের মধ্যকার সম্পর্ক পরীক্ষা করলে দেখা যায় যে এই ধরনের ঘটনাগুলো সাধারণত অস্থিরতার মাত্রার বৃদ্ধি ঘটায়, তবে অনিশ্চয়তা কেটে গেলে মার্কেটে পুনরুদ্ধার পরিলক্ষিত হয়। সামগ্রিকভাবে, সূচকটি শূন্যের কাছাকাছি রয়েছে, যা মার্কিন ট্রেডারদের ঝুঁকি গ্রহণ এবং ঝুঁকি গ্রহণ না করার প্রবণটার মধ্যে ভারসাম্য নির্দেশ করে।
এই বিশ্লেষণ নিশ্চিত করে যে বিটকয়েনের মূল্য শুধুমাত্র ক্রিপ্টো ইন্ডাস্ট্রির পরিস্থিতির দ্বারা প্রভাবিত হয় না, বরং সামগ্রিক বাজার পরিস্থিতির ওপরও নির্ভরশীল। যদি ভোক্তা মূল্য সূচক বা CPI প্রত্যাশার চেয়ে বেশি আসে, তাহলে এই সূচকের পতন নির্দেশ করে যে বিক্রির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মার্কিন বিনিয়োগকারীদের মাধ্যমে হয়েছে।
প্রতি বিটকয়েনের মূল্য এক মিলিয়ন: স্বপ্ন নাকি বাস্তবতা?
আর্ক ইনভেস্টের প্রধান ক্যাথি উড তার পূর্বাভাস পুনর্ব্যক্ত করেছেন যে ২০৩০ সালের মধ্যে বিটকয়েনের মূল্য $1.5 মিলিয়ন পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। এই পূর্বাভাস ক্রিপ্টো কমিউনিটিতে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি করেছে, তবে উড বিশ্বাস করেন যে এই সম্ভাবনা আরও শক্তিশালী হচ্ছে। তার অনুমান অনুযায়ী, বৈশ্বিক বিনিয়োগ তহবিল সম্পদের ৬.৫% বিটকয়েনে পুনর্বিন্যাস করা হলে এই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব।
আর্ক ইনভেস্ট বিটকয়েনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তিনটি সম্ভাব্য পরিস্থিতি তুলে ধরেছে: মধ্যম মাত্রার পূর্বাভাস অনুযায়ী এটির মূল্য $710,000-এ যাবে, রক্ষণশীল পূর্বাভাস অনুযায়ী মূল্য $300,000-এ যেতে পারে, এবং আশাবাদী পূর্বাভাস অনুযায়ী বিটকয়েনের মূল্য $1.5 মিলিয়নে উঠে যেতে পারে। এই পূর্বাভাসগুলো বার্ষিক যৌগিক প্রবৃদ্ধি হারের (CAGR) সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে যথাক্রমে ২১%, ৪০% এবং ৫৮% প্রবৃদ্ধির প্রতিফলন ঘটায়।
আর্কের বিশ্লেষকদের মতে, বিটকয়েনের ক্রমবর্ধমান প্রতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি এবং এর পরিকাঠামোর উন্নয়ন উল্লেখযোগ্য মূল্যবৃদ্ধির ভিত্তি তৈরি করছে। প্রধান আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমশ বিটকয়েনকে একটি সুরক্ষিত ইন্সট্রুমেন্ট হিসেবে বিবেচনা করছে, যা ঝুঁকি এবং মুনাফার মধ্যে একটি অনন্য ভারসাম্য তৈরি করছে।
বিটকয়েনের মূল্য কি নতুন সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছাবে?
বর্তমানে, সামষ্টিক অর্থনৈতিক কারণ এবং বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশার কারণে বিটকয়েন অস্থির অবস্থায় রয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং ফেডের নীতিগুলো সাময়িকভাবে এই ক্রিপ্টোকারেন্সির মূল্য বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। তবে, প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ, ডি-ফাই (DeFi) খাতের সম্প্রসারণ, এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন বিটকয়েনের ব্যবহার বাড়াচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি করছে।
মার্কেটে বারবার কারেকশন থেকে পুনরুদ্ধার করার সক্ষমতা পরিলক্ষিত হয়েছে। যদি বিটকয়েনের মূল্য এই অনিশ্চিত সময় পার করতে পারে এবং প্রধান সাপোর্ট লেভেলের ওপরে অবস্থান ধরে রাখতে পারে, তাহলে এটির মূল্যের নতুন সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে। তবে, এই পথ সহজ হবে না, এবং ট্রেডারদের আরও অস্থিরতকার জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত।
মূল প্রশ্ন এখনো রয়ে গেছে: বিটকয়েনের মূল্য কি নতুন রেকর্ড গড়বে, নাকি আমরা দীর্ঘমেয়াদী কারেকশন মুখোমুখি হচ্ছি? স্বল্পমেয়াদে, সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের চাপ বিটকয়েনের মূল্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা সীমিত করতে পারে, তবে উল্লিখিত কারণগুলো দীর্ঘমেয়াদে পরবর্তী মার্কেটে বুলিশ প্রবণতার শক্ত ভিত্তি তৈরি করছে। বিটকয়েন কেবলমাত্র একটি অ্যাসেট হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে না, বরং এটি ধীরে ধীরে বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থার একটি কৌশলগত উপাদান হয়ে উঠছে।